পদ্মা পাড়ের ইতিকথা: রেশম ও ঐতিহ্যের নগরী রাজশাহীর ইতিহাস

আজকের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, শিক্ষানগরী আর মিষ্টি আমের জন্য বিখ্যাত রাজশাহী শহরের রয়েছে এক সুপ্রাচীন এবং গৌরবময় ইতিহাস। পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি কেবল তার বর্তমান পরিচয়েই সমৃদ্ধ নয়, এর গভীরে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের নানা রাজবংশ, শাসন এবং সংস্কৃতির উত্থান-পতনের গল্প। চলুন, আজ ঘুরে আসা যাক রাজশাহীর ঐতিহাসিক পথ ধরে।

প্রাচীন যুগ: পুণ্ড্রবর্ধনের অংশ

রাজশাহীর ইতিহাসের শেকড় পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব যুগে। তখন এই অঞ্চলটি প্রাচীন ‘পুণ্ড্রবর্ধন’ রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। মৌর্য, গুপ্ত এবং পাল রাজবংশের শাসনামলে পুণ্ড্রবর্ধন ছিল উত্তরবঙ্গের এক সমৃদ্ধ জনপদ। বিশেষ করে পাল আমলে এই অঞ্চল জ্ঞান ও বৌদ্ধধর্ম চর্চার এক অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। নওগাঁর পাহাড়পুরে অবস্থিত পাল রাজা ধর্মপাল নির্মিত ‘সোমপুর মহাবিহার’ তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, যা আজকের রাজশাহীর খুব কাছেই অবস্থিত এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা পেয়েছে।

মধ্যযুগ: গৌড় থেকে রাজশাহী

পালদের পর সেন বংশের শাসন এবং তারপর তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির আগমনের মাধ্যমে এই অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। সুলতানি আমলে এই অঞ্চলের নাম হয় ‘গৌড়’। গৌড় ছিল বাংলার রাজধানী এবং এর প্রশাসনিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

মুঘল আমলে এই অঞ্চল আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এটিকে বিভিন্ন পরগণায় ভাগ করা হয়। এই সময়েই নাটোর, পুঠিয়া এবং দিঘাপতিয়ার মতো বিখ্যাত জমিদার বংশের উত্থান ঘটে, যাদের নির্মিত প্রাসাদ ও মন্দিরগুলো আজও রাজশাহীর স্থাপত্য ও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুঠিয়ার শিব মন্দির এবং গোবিন্দ মন্দির, আর নাটোরের রাজবাড়ী সেই সময়ের শিল্প ও সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়।

ব্রিটিশ আমল ও আধুনিক রাজশাহীর জন্ম

১৭৭২ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের সময় ‘রাজশাহী’ নামে একটি বিশাল জেলার গোড়াপত্তন করে। আজকের রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, এমনকি ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশও এই জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ব্রিটিশ আমলেই আধুনিক রাজশাহীর ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ‘রাজশাহী কলেজ’, যা এই অঞ্চলকে ধীরে ধীরে ‘শিক্ষানগরী’ হিসেবে পরিচিত করে তোলে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নীল বিদ্রোহ এবং অন্যান্য কৃষক আন্দোলনেও রাজশাহীর মানুষের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ ও আজকের রাজশাহী

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাজশাহী পূর্ব পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে রাজশাহীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এই গণঅভ্যুত্থানেই পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা, যিনি ছিলেন দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী ছিল ৭ নং সেক্টরের অধীনে। এই অঞ্চলের অলিগলিতে জড়িয়ে আছে অগণিত মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনী।

স্বাধীনতার পর রাজশাহী তার শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে। আজ এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শহর, যা তার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, বিখ্যাত আম, রেশম শিল্প এবং উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার জন্য গর্বিত। পুণ্ড্রবর্ধনের মাটি থেকে আজকের আধুনিক রাজশাহী—এই দীর্ঘ পথচলা শহরটিকে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র পরিচয়। ইতিহাস ও আধুনিকতার এই মেলবন্ধনই রাজশাহীকে করেছে অনন্য।